নারীকে টেনে নেওয়া গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ঢাবির সাবেক শিক্ষক
রুবিনা আক্তারকে এক কিলোমিটরের বেশি রাস্তা টেনে নিয়ে গাড়িটা যখন নীলক্ষেত মোড়ে থামল, সাধারণ একজন মানুষ হিসাবে আপনার তখন কি আশা করা উচিত?
কিন্তু আমাদের চাওয়া এবং কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট কারের পিছু নিয়ে যখন নীলক্ষেত পৌঁছালাম ততক্ষণে উত্তেজিত জনতা গাড়ি থামিয়ে ভিক্টিমকে গাড়ির নিচ থেকে বের করে ফেলেছে।
ড্রাইভারকে বের করে ধোলাই করছে জনতা।সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে গালি দেচ্ছে আর একটা হলেও কিল ঘুষি লাথি মারার চেষ্টা করছে ড্রাইভার এবং গাড়িতে। এক বান্দা গাড়ির ছাদেও উঠে গেছে। লাথি দিয়ে দিয়ে উইন্ডশিল্ড আর উইন্ডো গ্লাস ভাঙায় ব্যস্ত সে। আর এই মারামারি ভাংচুরের দৃশ্য ভিডিও করতে ব্যস্ত আরেকদল মানুষ।
সবাই এত ব্যস্ত,এত উত্তেজিত যাকে কেন্দ্র করে সেই রুবিনা আক্তার নিথরভাবে পরে আছে রাস্তার অন্য পাশে।শুধু হৃৎপিণ্ডডা ছটফট করছে।
তাকে ঘিরে ছবি তোলা আর ভিডিওতে ব্যস্ত একদল মানুষ,আরেকদল ব্যস্ত পকেটে হাত দিয়ে এক্সিডেন্টের দুঃখে হা হুতাশ করতে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এটা কারও মনে পড়ছে না।সবাই ভুলে গেছে।
সাইকেল নিয়ে ভিড় ঠেলে যতটুকু সম্ভব সামনে গিয়ে এক রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম মামা জলদি রিক্সা আনেন! হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। আমার মায়ের সেই ভাই, রিক্সা পিছায়ে উল্টো দিকে চলে গেল। খোদার কসম! মন চাইছিল একটা টান দিয়ে কল্লা ছিড়ে ফেলি!
চিল্লায়ে যতই বলি কেউ একটা রিক্সা ডাকেন, হাসপাতালে নেওয়া লাগবে, কেউ একটা ভ্যান ডাকেন। কেউই কথা কানে নেয় না।সবাই ব্যস্ত ভিডিও করতে। কয়েক মুহুর্ত পরে এক ভাই একটা ভ্যান নিয়ে আসল পিছন থেকে।ভ্যানে তুলে রুবিনা আক্তারকে নেওয়া হল ঢাকা মেডিকেলে। ইমার্জেন্সিতে তার সাথে ছিল একজন আপু। যিনি নিজেও র্যান্ডম একজন পথচারী।
ইমার্জেন্সি রুম থেকে যখন ইসিজি রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম রুবিনা আক্তারকে, ঐ আপু কান্নায় ভেঙে পরছিলেন বারবার। ইসিজি রুম থেকে রিপোর্ট নিয়ে ইমার্জেন্সি রুমে ব্যাক করার পরে যখন সার্টিফাই করল "শি ইজ নো মোর",ঐ আপু আবারও কান্নায় ভেঙে পরলেন।
ইমার্জেন্সি রুমে আরেকজন ভাই ছিল। কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি সাংবাদিক। আপুর থেকে,আমার থেকে বেশ কিছু তথ্য নিলেন। ভিক্টিমকে যখন ডেড ঘোষণা করা হল তখনও তার ফ্যামিলির কেউ উপস্থিত নেই সেখানে।ওনার দেবর ছিলেন রক্তের খোজে বাইরে। আছি শুধু আমি আর ঐ আপু।আর দুই সাংবাদিক ভাই। রুবিনা আক্তারকে মৃত ঘোষণার পরেই এক সাংবাদিক ভাই আমাকে বললেন," ভাই চলেন,এখানে আর থাকার দরকার নেই।" আমি অস্বীকৃতি জানালে সে নিজেই বের হয়ে গেল।তার কাজ শেষ সেখানে।কালেক্ট করার মত কোন ইন্টারেস্টিং আর কিছু নেই।
এইযে মানুষের ব্যবহার; একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ফেলে রেখে ছবি তোলা বা ভিডিও করা,এগুলো কিভাবে শুরু হল?বা এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? আমার জানা নেই। আছে শুধু একরাশ খারাপ লাগা অনুভুতি।
আগে অনেক শুনেছি অসহায় মানুষকে ফেলে রেখে মানুষ ফটোগ্রাফি-ভিডিওগ্রাফি-লাইভ স্ট্রিমিং এ ব্যস্ত হয়ে যায়। আজ নিজে প্রত্যক্ষ করলাম।
পথচারী লোকগুলো কি পারত না রুবিনা আক্তারকে ভিডিও না করে সাথে সাথেই মেডিকেলে নিয়ে যেতে বা ঐ রিক্সাওয়ালা মামা কি পারত না এগিয়ে আসতে? বা ঐ সাংবাদিক ভাইটির দায়িত্ব কি শুধুই তথ্য কালেক্ট করা? দায়িত্বের উর্ধ্বে মানবিকতা বলে কি কিছু নেই? তিনি কি পারতেম না রোগীর স্বজন কেউ আসা অব্দি আমাদের সাথে অপেক্ষা করতে?
মানবিক দিক বিবেচনা করার মত মানবিকতাও আমাদের মধ্যে আর নেই। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে মানবিকতা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে!
No comments