একটি বোন থাকা কেন জরুরি?
আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ভাবতে, আমার যদি একটা সহোদর বোন থাকতো, তবে কেমন হতো আমার জীবনটা?
যদি আমার একটা ছোট বোন থাকতো, তাহলে হয়তো প্রতিদিন সকালে ওর দরজা ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাংগতো, বিরক্ত হতাম, দরজা খুলে ওর মাথায় চাটি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম, ও চাটি খেয়েও আবার একটু পর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবার নতুন উদ্যোমে আমার রূমের দরজা ধাক্কাতো।
কলেজে যাবার আগে আমার কাছে রিকশা ভাড়া চাইতো, মোবাইলে ফ্লেক্সি করে দিতে বলতো। দুপুরে ইনবক্সে মেসেজ পাঠাতো - ‘ভাইয়া, লাঞ্চ করতে ভুলিস না।” বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে আমার ঘরে ঢুকে আমার ঘরটা গুছিয়ে দিতো, বিছানার চাদর পাল্টে, কাউচে রাখা পোষাকের স্তুপ সরিয়ে, চেষ্ট অব ড্রয়ারে সব গুছিয়ে রেখে, ফ্লোরটা ঝাঁট দিয়ে পানি দিয়ে মুছেও দিতো।
রাতে ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরার পর রূমে ঢুকেই আমার মনটা ভালো হয়ে যেতো। আর আমাকে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে বলতো - ”রূমটা এইভাবে নোংরা করে রাখতে কিভাবে পারিস তুই?” কিছুক্ষন পর পর আমার রূমে এসে ডিনারের জন্য তাগাদা দিতো।
আমি যখন আমার চিরাচরিত নিয়মে রাত ২টায় ডাইনিং টেবিলে খেতে যেতাম, আমার বাতি জ্বালানো আর ডাইনিংয়ের খুটখাট আওয়াতে ও ঘুমঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে এসে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে আমার জন্য গরম করতে করতে বলতো - “এই তোর আসার সময় হলো? রাতে কতখন তোর জন্য খাবার নিয়ে বসে ছিলাম!” ওকে বলতাম - ”আয়, তুইও আমার বস, একসাথে খাই!” এখন যেমন খাবার গরম করে একা একা বসে খাই, তখন আর এমনটা করতে হতো না।
পড়ার টেবিলে বসে কোন একটা সিলি প্রশ্ন শুনে ওর উপর রাগ হতো, এত গাধী ক্যান তুই? ও আমার ধমক খেয়ে মন খারাপ করলে পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ওর জন্য ফুচকা, চুড়ি কিংবা নতুন কোন বই নিয়ে বাসায় ঢুকতাম। আমার লাইব্রেরিটা থাকতো ওর দখলে। আমার বোনটা আমার মতই বইপড়ুয়া হতো, আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম আমার বোনটা আমার বুক সেলফ থেকে বই নিয়ে হাভাতের মতো বই পড়ছে ছুটির দিনগুলোতে। আর বিভিন্ন সময় বলছে - ”ভাইয়া, আমার অমুক বইটা লাগবে, নেক্সট টাইম নীলক্ষেতে গেলে নিয়ে আসিস তো মনে করে!”
আমার অনুপস্থিতে হয়তো আমার ঘরে ঢুকে উসখুস করতো, আমি কার সাথে রাত জেগে কথা বলি, তার হবু ভাবীটা কি করছে, কোথায় কি করে, এসব সে নিয়মিত খোজঁ নিতো, তার ভাবীর সাথে তার প্রায়ই কথা হতো। আমার বিরুদ্ধে নিয়মিত নালিশও দিতো তাকে। আমার বিয়ের পর সে হাফ ছেড়ে বাচঁবে, তাকে আর আমার ঘর গোছাতে হবে না, লন্ড্রির কাপড়গুলো গোছাতে হবে না, মোজার জন্য আমার ঝাড়ি শুনতে হবে না, রাতে খাবারের টেবিলে অপেক্ষাও করতে হবে না। এইসব কাজগুলোতে তার চিরদিনের জন্য ছুটি মিলেছে, এইসব ভেবে সে আনন্দে আত্নহারা হতো।
নতুন পরিচয় হওয়া ছেলে বন্ধুটির সাথে কথা বলতো লুকিয়ে চুরিয়ে, ছেলেটি রাতে কল দিলে বলতো - “এত রাতে কল দিলে ভাইয়া বকবে।” হুম সত্যিই হয়তো বকতাম ওকে। আমি নিজেও টেনশনে থাকতাম, কলেজে যাবার পথে কোন ছেলে না ওকে টিজ করে বসে, কোন ছেলে ওকে ফলো করে না তো? কোন ছেলে ওর সাথে ইনবক্সে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে না তো? ওর কোন বান্ধবীর বড় ভাই আবার ওকে প্রপোজ টপোজ করে বসেনি তো? এইরকম রাজ্যের টেনশনে থাকতাম।
বাসায় কখন কি হয়েছে, আব্বু-আম্মু কার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কখন কেমন, সব এক নিমিষে সিস্টেম ড্যাশবোর্ডের মতো খবর পেয়ে যেতাম। আমার জন্মদিনে সবচে সুন্দর গিফটটা দিতো আমার বোন, আর কিছু না হোক, বাসার সবার আগে সে উইশ করতো, দেখা যেতো পরদিন সন্ধ্যায় সে কলেজের ভাড়া বাচিঁয়ে আমার জন্য একটা বড় সড় কেকও কিনে নিয়ে এসেছে। আমি ওর এসব কান্ড দেখে কপট রাগের ভান করে আড়ালে চোখের পানি মুছতাম, এই বোনটা একদিন বিয়ে করে স্বামীর ঘরে চলে যাবে, তাকে আর এমন করে কখনো কাছে পাবো না - এই কথা ভেবে। আমার জ্বর হলে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়াতো, মাথায় পানি ঢেলে দিতো, হয়তো ভাত মাখিয়ে খাইয়েও দিতো।
আর যদি একটা বড় বোন থাকতো, তাকে ভয় করতাম, আমাকে রাত জাগতে দিতো না মোটেও। বকা দিতো, খাওয়া ঘুম ঠিকমতো না করার জন্য। তবে যখন তখন আপুর কাছে মোবাইলের ফ্লেক্সির টাকা চাইতে পারতাম, হাত খরচ চাইতে পারতাম, আজিজে দেখা কোন নতুন টি শার্ট কিনে দেবার জন্য বায়না ধরতে পারতাম। আপুর কাছে প্রতি মাসেই চায়নিজে খেতে যাবার বায়না ধরতে পারতাম। ফিউচার দুলাভাইকে নিয়ে খুনসুটিঁ করতাম। আর কতো কি করতাম...!?
মাঝে মাঝে ভাবি, আমার যদি একটা বড় কিংবা ছোট বোন থাকতো, তাহলে আমার জীবনটা সত্যিই কেমন হতো? আমার খুব ইচ্ছে করে এটা জানতে।
No comments