Header Ads

Header ADS

রুপপুর কি দ্বিতীয় চেরনোবিল হবে?

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর উৎসুক মানুষের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা নিরাপদ? রুপপুর কি দ্বিতীয় চেরনোবিল হবে? 
সরাসরি উত্তর হচ্ছে, "রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দ্বিতীয় চেরনোবিল হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে।" এতোটুকু উত্তর মানুষের অনুসন্ধানী মনকে সন্তুষ্ট করবেনা স্বাভাবিক। চেরনোবিল দুর্ঘটনা কোন পরিস্থিতিতে ঘটেছে এবং রূপপুরের পরিস্থিতি কতটা ভিন্ন হবে তা অনেকেই জানতে চাইবেন যাতে একই ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়। চেরনোবিল বিস্ফোরণের কারণ আগে আলোচনা করা যাক :

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৮৬ সাল। দুর্ঘটনাটি ডিজাইনের ত্রুটি এবং গুরুতর অপারেশনাল ত্রুটির কারণে ঘটেছিলো। চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুল্লীর সংখ্যা ছিল ৪টি, ৪ নং চুল্লীতে পরীক্ষা চলাকালীন সময় চুল্লীর পাওয়ার রেগুলেটিং সিস্টেম ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ ছিলো। একটি পারমাণবিক চুল্লী বন্ধ হওয়ার পরেও কোরের ভিতর উচ্চ তেজস্ক্রিয়তার কারণে যথেষ্ট তাপ উৎপন্ন হয়। চুল্লী বন্ধ হওয়ার পর অবশিষ্ট তাপ অপসারণের জন্য সব পাওয়ার রিঅ্যাক্টরে কোর কুলিং সিস্টেম থাকে। কোর কুলিং সিস্টেমে বাহ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব না হলে, স্টোরেজ ব্যাটারি এবং ডিজেল জেনারেট দিয়ে জরুরী শক্তি সরবরাহ করা হয়। এই ডিজেল জেনারেটর শুরু হওয়ার আগে অল্প সময়ের জন্য জরুরী সরবরাহ পরিচালনা করতে টারবাইনের জড়তা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে কিনা তা দেখার জন্য কিছু প্রকৌশলী চুল্লিতে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। 
পরীক্ষাটি যারা করেছিলেন তাদের রিঅ্যাক্টর ফিজিক্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কেও প্রাথমিক জ্ঞানের অভাব ছিল। পরীক্ষাটি করার সময় চুল্লী অপারেটররা শাটডাউন মেকানিজম, ইমার্জেন্সি কোর কুলিং সিস্টেমসহ রিঅ্যাক্টরের অনেকগুলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। ফলে পরীক্ষার সময় পারমাণবিক চুল্লির শক্তি বাড়তে শুরু করে, বাষ্প বুদবুদ সৃষ্টির কারণে টারবাইন দ্বারা উৎপাদিত শক্তি কোর কুলিং সিস্টেম বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত ছিলোনা। ফলে চুল্লি বন্ধ করার আগেই চুল্লির শক্তি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, হঠাৎ পাওয়ার সার্জের ফলে কোর অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হওয়া শুরু হয়। উচ্চ বাষ্পচাপের ফলে একটি পাইপ বিস্ফোরিত হয়, ভবনের ছাদ ফেটে যায়। তারপর আরও বিস্ফোরণ ঘটে, রেডিয়েশন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। চেরনোবিলে মূলত পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেনি বরং পাইপের ভিতরে উচ্চ বাষ্পচাপের কারণে বিস্ফোরণ হয়।
পারমাণবিক চুল্লী মূলত কন্টেইনমেন্ট ভবনের ভিতর রাখা হয়। কন্টেইনমেন্ট ভবন এক ধরনের গম্বুজের মতো কাঠামো যা চুল্লীর চারপাশে তৈরি করা হয় যাতে চুল্লীর কোর থেকে দূর্ঘটনাক্রমে বেরিয়ে আসা তেজস্ক্রিয়তা বায়ুমণ্ডলে ছড়াতে না পারে। কন্টেইনমেন্ট ভবনের ভিতরের চাপ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের চেয়ে কম রাখা হয় এবং এর ফলে ভেতর থেকে বাতাস বাইরে বের হতে পারে না। চেরনোবিলের চুল্লীতে এমন কন্টেইনমেন্ট ভবন ছিলোনা, ফলস্বরূপ তেজস্ক্রিয়তা বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে আধুনিক রাশিয়ান চুল্লীগুলো কন্টেনমেন্ট বিল্ডিংসহ নির্মিত হয়। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও কন্টেনমেন্ট বিল্ডিংসহ তৈরি করা হবে। এছাড়া নামমাত্র অতিরিক্ত খরচে চুল্লীর চারপাশে ডবল কন্টেনমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করা সম্ভব।

চেরনোবিলে ব্যবহার করা হয়েছিলো ২য় প্রজন্মের রিয়েক্টর। অন্যদিকে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে প্রেশারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টর (PWR), সম্ভবত ৩য় প্রজন্মের। PWR এর মূল অংশে জ্বালানী হিসেবে থাকবে সামান্য ইউরেনিয়াম। প্রশমক ও কুল্যান্ট হিসেবে থাকবে পানি। এই সংমিশ্রণে ভয়েড কো-ইফিশিয়েন্ট নেগেটিভ অবস্থার সৃষ্টি হবে যা সিস্টেমকে স্থিতিশীল রাখবে। চুল্লীর কোরে শক্তি বৃদ্ধির ফলে যদি কোন ফাঁকা স্থান বা ভয়েডের সৃষ্টি হয় তবে ভয়েড কো-ইফিশিয়েন্ট নেগেটিভ অবস্থায় শক্তির পরিমাণ কমে আসবে। অতএব চেরনোবিলের ৪ নং চুল্লোর মতো রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের PWR রিয়েক্টরে পাওয়ার সার্জ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চেরনোবিলের মতো বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নেই।

রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্বাচিত PWR চুল্লীতে বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো রোধ করার জন্য পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এগুলো হলো : ফুয়েল পেলেট, ফুয়েল ক্ল্যাডিং, রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল, প্রথম কন্টেইনমেন্ট ভবন, দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট ভবন। এই পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ৩য় প্রজন্মের চুল্লীগুলো ২য় প্রজন্মের চুল্লীর তুলনায় নিরাপদ এবং লাভজনক। এছাড়াও, ৩য় প্রজন্মের চুল্লীতে প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম থাকে যা অপারেটরের কোনও পদক্ষেপ ছাড়াই কার্যকর হয়৷ কোর কুলিং সিস্টেমের চালিকা শক্তি আসবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, পরিচলন প্রবাহ এবং গ্যাস অ্যাকুমুলেশান থেকে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ৩য় প্রজন্মের চুল্লীতে থাকলেও, চেরনোবিলের ২য় প্রজন্মের চুল্লীতে ছিলোনা। 
রূপপুর চুল্লী পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীদের দল গঠিত হবে। প্রকৌশলীরা দেশে এবং বিদেশে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যাবে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষে চুল্লী অপারেটর পদ অর্জন করতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র লাইসেন্সধারীরা রূপপুরে চুল্লী পরিচালনা করতে পারবেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং চুল্লীতে চেরনোবিলের মতো কোনো ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়া হবে না। এছাড়াও, আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় সার্বক্ষণিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়, যাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকার পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা সহনশীলতার মাত্রা অতিক্রম না করে। আবার, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিম্ন ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও কোনো ক্ষতি হবেনা। 
উন্নত আধুনিক নকশা, আধুনিক চুল্লী, প্রশিক্ষিত অপারেটর, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এতো পদক্ষেপের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চেরনোবিলের মতো একটি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

No comments

Featured Post

The Future Space Tourism - 2050

 In the next three decades, human beings will enter the realm of space like never before. This is partly due to the way that public interest...

Popular Post

Powered by Blogger.