পটেটো ক্রাকার্সের দাম বাড়ে না কেন?
এত বছর পরেও বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্রাকার্সের দাম ১০ টাকাই আছে কীভাবে?
১৯ কিংবা বিশের দশকে বড় হয়েছে কিন্তু বোম্বে সুইটস পটেটো ক্র্যাকার্সের নাম শোনেনি কিংবা একবার হলেও টেস্ট করে দেখেনি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া আসলেই দুষ্কর। ১৯৮৮ সালে বোম্বে সুইটস প্রথম চিপসটি বাজারে ছাড়ে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছেলে, বুড়ো সবার কাছে সমান ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ পরিণত হয় বাঙালির 'জাতীয়' চিপসে। কিন্তু সবচেয়ে আইকোনিক বিষয় হচ্ছে সেই ১৯৮৮ সালে বাজারে ছাড়ার পর থেকে ২-৩ বার দাম বাড়ানোর পরেও শেষ ১০-১৫ বছর পর্যন্ত নিজের ১০ টাকার গৌরব ধরে রেখেছে চিপসটি। মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আরো নানা সমস্যাকে পাশে কাটিয়ে বোম্বে সুইটস পটেটো ক্রাকারস কীভাবে ধরে রেখেছে নিজের ১০ টাকার সুনাম? আজ সেটাই জানবো৷
বোম্বে সুইটসের ওয়েবসাইট ঘেটে জানা যায় পটেটো ক্র্যাকার্সে তারা মূলত গুড়ো করা আলু, স্টার্চ, পরিশোধিত উদ্ভিজ্জ তেল, আটা এবং বিভিন্ন মশলা ব্যবহার করে থাকে। ১৯৯০ সালের দিকে যেই আলুর দাম কেজিপ্রতি ছিল মাত্র ১-২ টাকা, ২০১০ সালে এসে দাঁড়ায় ৫ টাকায়, আর বর্তমানে আলুর দাম এসে দাড়িয়েছে কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকায়৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে গত ৩০ বছরে আলুর দাম প্রায় ১০-২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ পাশাপাশি চিপস তৈরির অন্য সকল উপাদানের দামই বেড়েছে কয়েক গুণ।
কিন্তু যদি পটেটো ক্র্যাকার্সের দামের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন ১০ টাকার প্যাকেট কিছু ব্যতিক্রম বাদে আগের মতই ১০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য যাত্রার শুরুর দিকে ৫ টাকা, পরে ৭ এবং কিছুদিনের মধ্যে ৮ টাকায় বিক্রি হলেও শেষ ১০-১৫ বছর ধরে ১০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে চিপসটি। মূলত চিপসের মত প্রোডাক্ট গুলো খুবই দাম নির্ভর৷ অর্থাৎ এগুলোর দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে চাহিদার পরিমাণ কমে যেতে পারে কয়েক গুণ। যার কারণে বোম্বে সুইটস মানুষের সাইকোলজিকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের দাম আগের মত রেখে বরং এর পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। যারা ভালো করে লক্ষ্য করেছেন তাদের দৃষ্টিগচর হওয়ার কথা ১০-১৫ বছর আগে ১০ টাকায় ২৫ গ্রামের প্যাকেট পাওয়া যেত। ২০১৮ সাল নাগাদ এর পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ২২ গ্রামে। আর ২০২২ সাল আসতে আসতে বর্তমানে ১০ টাকায় মাত্র ১৮ গ্রাম চিপস পাওয়া যাচ্ছে৷ কিন্তু প্যাকেট কিন্তু রয়েছে আগের মতই। শুধু দিন দিন কমছে চিপসের পরিমাণ, আর বাড়ছে বাতাসের পরিমাণ। অবশ্য এই বাতাসের কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। শুধু যে পরিমাণে বেশি দেখাতে হবে বলেই ব্যবহার করা হয় এটা ভাবলে ভুল করবেন৷ বাতাস ব্যবহারের রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। চিপস গুলো যেন এসেম্বলি লাইন থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আপনার হাতে পৌছানো পর্যন্ত চাপে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য বাতাস ব্যবহৃত হয়। এই বাতাস না থাকলে হাতে পেতেন ভাঙা চুড়া চিপস। পাশাপাশি এই বাতাস কিন্তু যে সে বাতাস নয়। এখানে ব্যবহার করা হয় নাইট্রোজেন। মূলত অক্সিজেনের প্রভাবে চিপস নষ্ট হয়ে যায়, এছাড়া তেলেও দেখা দেয় দুর্গন্ধ। সেই সাথে বাতাসের আর্দ্রতা চিপসকে ড্যাম্প করে দিতে পারে। ফলে সেই চিপস খেয়ে আদতে কোনো মজাই পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে নাইট্রোজেনের কিন্তু এসব কোনো সমস্যা দেখা যায় না। বরং এটি চিপসকে রাখে সতেজ ও কুড়মুড়ে।
অর্থনীতির ভাষায় দাম একই রেখে কোয়ান্টিটি বা পরিমাণ কমানোকে বলে 'Shrinkflation'. এই দাম একই রাখার কারণে এবং ধীরে ধীরে পণ্যের পরিমাণ কমানোতে ক্রেতারা একই দামে আগের তুলনায় কম জিনিস পাওয়ার বিষয়টিকে নজরে আনেন না৷ যার কারণে মনের মধ্যে সন্তুষ্টি কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে একই পণ্যের ক্ষেত্রে পরিমাণ একই রেখে দাম বাড়ালে ক্রেতারা ওই পণ্য কেনায় যে পরিমাণ নিরুৎসাহিত হন, দাম একই রেখে পরিমাণ কমালে সে পরিমাণ নিরুৎসাহিত হন না৷ অর্থাৎ দাম একই রাখাটাই এখানে বুদ্ধিমানের কাজ৷
এছাড়া এই চিপসগুলোর ক্ষেত্রে টার্গেট মার্কেট থাকে ছোট শিশুরা। যাদের পকেট মানি থাকে অনেক কম, কিংবা বাবা-মারা চিপস জাতীয় কিছু কিনলে সবচেয়ে কম দামী, কিন্তু মানে ভালো প্রোডাক্টের দিকেই ঝোকেন বেশি। বোম্বে সুইটস ভালো করেই জানে দাম বাড়ালে তারা তাদের মূল ক্রেতাদের হারিয়ে ফেলবে৷ কারণ বোম্বে সুইটস এর পটেটো ক্র্যাকার্সকে টেক্কা দিতে পারে এমন ভিন্ন স্বাদের, এমনকি অন্য বিভিন্ন ব্রান্ডের একই দামের পটেটো ক্র্যাকার্স বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্যাকেটিং এবং কালার চয়েজও প্রায় অভিন্ন ব্রান্ডগুলোর। এক্ষেত্রে মার্কেট ধরে রাখার সেরা উপায় নিজেদের পণ্যের দাম আগের মতই রাখা৷
আপনি কী এখনও বোম্বে সুইটসের পটেটো ক্রাকার্স খান? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না৷
No comments