মানুষের মন কিভাবে পড়তে হয়?
মিসির আলীর ভক্তরা নিশ্চয়ই "বাঘবন্দী খেলা" বইটির ফতের বিশেষ ক্ষমতার সাথে সুপরিচিত। যারা জানেন না তাদের জানিয়ে রাখি, ফতের এই বিশেষ ক্ষমতাটি হলো মাইন্ড রিডিং বা কোন প্রকার যোগাযোগ ব্যতীতই অন্যের মনের কথা বুঝে ফেলা। কাল্পনিক চরিত্রদের এই বিশেষ ক্ষমতা সাধারণ মানুষরা কিভাবে পেতে পারে? চলুন ঘুরে আসা যাক সাইকোলজির সেই দুনিয়া থেকে যেখানের অধিকাংশ খবরই লুকায়িত!!
প্রথমেই আসা যাক টেলিপ্যাথি আর মাইন্ড রিডিং এর পার্থক্যে। টেলেপ্যাথি আর মাইন্ড রিডিং এরা পুরোপুরি এক নয়, টেলিপ্যাথি হলো টু ওয়ে কমিউনিকেশন আর মাইন্ড রিডিং হলো ওয়ান ওয়ে। যার মানে দাঁড়ায় যে, মাইন্ড রিডিং এর ক্ষেত্রে অন্যজনের মাইন্ডে কি চলছে তা আপনি জানতে পারবেন কিন্তু সে জানতে পারবেনা আপনার মাথার ভেতর কি চলছে! অপরদিকে টেলিপ্যাথির বেলায় আপনারা দুইজনই জানবেন যে কার মাইন্ডে কি চলছে। এখানে, কষ্টের কথা হচ্ছে সরাসরি মাইন্ড রিডিং করতে সক্ষম মানুষের দেখা মেলা এখনো বাকি। ( অটিজম এবং বিশেষ কিছু মানসিক রোগীদের মধ্যে মাইন্ড রিডিং-র অদ্ভুত কিছু ক্ষমতা লক্ষ্য করা গেছে, তবে ঠিক কিভাবে তারা এমনটি করে তা জানা যায় নি!!) তাই বলে কি আমরা মানুষের মন পড়তে পারবো না, তাহাদের মনে কি চলতেছে জানতে পারবো না?? আমার মানবজীবন কি তাহলে বৃথা!!! জ্বি না! যদি বলেন নিয়ম কয়েকখানা আছে বৈকি!
★ বিহেভিয়ার রিডিং বা আচরণ পড়া :
এই পদ্ধতিতে একজন অন্য আরেকজনের আচরণ, তার ভাবভঙ্গী, তার বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে বলে দেয় যে তার মনে কি চলছে, তার পরবর্তী পদক্ষেপটি কি হতে পারে। অপরাধীদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা জানতে অপরাধ বিভাগের কর্মকর্তাগণ এই বিশেষ পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকেন। এখানকার কিন্তুটি হচ্ছে, যদি যিনি আচরণ পড়তে যাচ্ছেন এবং যার আচরণ পড়তে যাচ্ছেন দুইজনেরই যদি আচরণগত নিদর্শন তৈরি করার ক্ষমতা থাকে তাহলে আচরণ-পঠন ভালভাবে কাজ করে না। আচরণগত নিদর্শন বলতে আরেকজনের চোখে ধুলো দেওয়ার ক্ষমতাকে বোঝানো হচ্ছে যেমন এখানে যদি আপনার আচরণ পড়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে আপনি আপনার আচরণ এমনভাবে পরিবর্তন করবেন যেন আপনার সামনের মানুষটি বুঝতে না পারে আপনার সত্যিকারের বিহেভিয়ার প্যাটার্নটি কেমন,, ফলাফল আপনার আচরণ অন্যজন পড়তে পারবে না। নেটফ্লিক্স সিরিজ Don't f... With Cats এ লুকা ম্যাগনট্টার (Luka Magnotta) কিংবা কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার Yoo Young Chul এর বিহেভিয়ার প্যাটার্ন এই ধোকা বাজির মধ্যে পরে! আবার যিনি আচরণ পড়বেন তার তুখোড় নজরের সাথে নিজের ইমোশন লুকানোর ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তার মধ্যেও ধোকা দেওয়ার ক্ষমতাটি লাগবে। এখন দুইজনই যদি একই লেভেলের ধোকা দিতে সক্ষম হয় তাহলে তো ঝামেলা হবেই।
মানুষের মন বোঝার উপায় কি?
এবার আসা যাক কিছু যন্ত্রপাতির কথায় যারা আপনার কাজ লাঘব করে দিবে। এই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে পলিগ্রাফ বা লাই ডিটেক্টর। পলিগ্রাফ ব্যবহারকারীর শারীরবৃত্তীয় নানা কর্মকাণ্ড যেমন- রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বকের নানা প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি দ্বারা ব্যবহারকারীর মিথ্যা বা প্রতারণামূলক উত্তর বের করে। এর ভিত্তি হলো- প্রতারণামূলক উত্তরগুলো শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে যার ফলে সঠিক উত্তরগুলোর থেকে মিথ্যা উত্তরগুলোকে আলাদা করা যেতে পারে। যাইহোক, মিথ্যা বলার সাথে সম্পর্কিত কোন নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া নেই, তাই পারতপক্ষে কোনটি সত্য বলছে বা কোনটি মিথ্যা বলছে তা আলাদা করে সনাক্ত করা কঠিন। এই কারণে পলিগ্রাফ পরীক্ষকরা কম্পিউটারাইজড কৌশলের সাথে তাদের নিজস্ব স্কোরিং পদ্ধতি ব্যবহার করে, এটি তাদের নিজস্ব মূল্যায়নকে আরও সঠিক করতে সাহায্য করে ।
কিছু দেশে, পলিগ্রাফ অপরাধী সন্দেহভাজন বা গুরুত্বপূর্ণ সরকারী বা বেসরকারী খাতের চাকরির প্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদের সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহৃত হয় । মার্কিন আইন প্রয়োগকারী এবং ফেডারেল সরকারী সংস্থা যেমন এফবিআই , এনএসএ , এবং সিআইএ-সহ অনেক পুলিশ বিভাগ যেমন এলএপিডি এবং ভার্জিনিয়া স্টেট পুলিশ সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এবং নতুন কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পলিগ্রাফ পরীক্ষা ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার, পলিগ্রাফ পরীক্ষাকে সাইকোফিজিওলজিক্যাল ডিটেকশন অফ ডিসেপশন (PDD) পরীক্ষা হিসাবে উল্লেখ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলিগ্রাফ পরীক্ষা পরিচালনার গড় খরচ হয় $700 এর বেশি এবং বর্তমানে এটি $2 বিলিয়ন শিল্প খাতের অংশ হিসেবে মজুদ।
তবে,, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুফল হিসেবে মাইন্ড রিডিং-এর ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু সংস্করণ।
নিউরোসায়েন্টিস্ট ব্রাইস কুহল ও তার সহকর্মী হংমি লি আবিষ্কার করেন মানুষের মন পড়ার যন্ত্র যা পুরোপুরি সফল না হলেও অনেকখানি সফল। একটি এমআরআই, কিছু মেশিন লার্নিং সফ্টওয়্যার ও AI এর সাহায্যে কিছু মানুষের উপর পরীক্ষা করে কুহল এবং লি তাদের স্মৃতি থেকে সরাসরি ছবি তৈরি করেছেন। তবে সেই ছবি পুরোপুরি স্পষ্ট নয়!
জাপানের কিয়োটোর কিয়োটো ইউনিভার্সিটির চারজন বিজ্ঞানী গুওহুয়া শেন, তোমোয়াসু হোরিকাওয়া, কেই মাজিমা এবং ইউকিয়াসু কামিতানি সমন্বিত ভাবে এমন এক যন্ত্রের আবিষ্কার করেছে যেটি গভীর নিউরাল নেটওয়ার্ক (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে মানুষের চিন্তাভাবনা "ডিকোডিং" করতে সক্ষম। যন্ত্রটি লোকটি কি চিন্তা করছে তার কিছু প্রতিচ্ছবি দেখাতে সক্ষম হয়। এটি বস্তুর একটি হালকা ধারণা, ত্রিমাত্রিক ছবি এবং অনেকটুকু আন্দাজ করতে সক্ষম হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এর সংস্কারকাজ চলছে এখনো।
কিভাবে মানুষের মন পড়ে ফেলবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই?
বিজ্ঞানী কামিতানি এবং ব্রাইস কিন্তু এখনো তাদের যন্ত্রের পেছনে লেগে আছেন যাতে ভবিষ্যতে মানুষের মন পড়তে ঝামেলার সম্মুখীন হতে না হয়। তবে প্রশ্ন একটা থেকেই যায় যে, এই যন্ত্রগুলো আমাদের জন্য আশীর্বাদ হবে নাকি হতে যাচ্ছে কাল? এখন শুধু সময়ই বলে দিতে পারে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে!
No comments