আমাদের ঘুম কিভাবে আসে?
ঘুম আমাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আমরা যদি প্রায় প্রতিদিন ৮ ঘন্টা করে ঘুমাই তাহলে জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমিয়েই কেটে যাবে! আচ্ছা ঘুমাতে হয় কেন? না ঘুমালে কি হয়? আসলে অনেক কিছুই হয়। ঘুম ও খাবার- অক্সিজেন এর মতোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের আসলে ঘুম কিভাবে আসে?
আমাদের মস্তিস্কের অভ্যন্তরে বাদামের মতো দেখতে ছোট একটি অংশ রয়েছে। যাকে আমরা হাইপোথ্যালামাস বলে থাকি। হাইপোথ্যালামাস কে ঘুমের নিয়ন্ত্রক বলা হয়। ঘুম আসার জন্য দুইটি হেমোস্ফিয়ার মাঝে অবস্থিত পিনিয়েল গ্রন্থি/গ্ল্যান্ড থেকে মেলাটনিন হরমোন নিঃসরণ হয়। তখন আমরা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের ঘুম এর দুটি ধরণ রয়েছে। Rapid eye movement(REM)
আর Non-rapid eye movement (Non REM)।
একটি পূর্ণ স্লিপ সাইকেল/ঘুম চক্রতে তিনটি পর্যায় থাকে।
পর্যায় ১: ঘুম এ পর্যায়ে শুরু হয় Non REM ধরণের মাধ্যমে। Non REM ঘুম হচ্ছে সজাগ অবস্থা থেকে ঘুম এ প্রবেশ করার মধ্যবর্তী সময়। এসময় ধীরে ধীরে পেশি সুস্থির হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন কমে আসে এবং মস্তিস্ক থেকে "ব্রেইন ওয়েবস" এর নিঃসরণ হতে শুরু করে। এই পর্যায় কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়।
পর্যায় ২: ঘুমের আরো গভীর স্তরে প্রবেশ করা হয় পর্যায় ২ পার করার মাধ্যমে। শরীরের তাপমাত্রা তখন কমতে শুরু করে। চোখের পাতা নড়াচড়া করা বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ পর্যায় ২ তেই ঘুমের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে।
পর্যায় ৩: পর্যায় ৩ তে মানুষ পরিপূর্ণ গভীর ঘুম এ প্রবেশ করে। মস্তিস্কের "ব্রেইন ওয়েবস" নিঃসরণ অনেক ধীর হয়ে যায়। হৃদপিণ্ড সংকোচন-প্রসারণ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস এর মাত্রা সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌছে। এসময় একজন মানুষ কে জাগিয়ে তোলা কঠিন হয়।
REM: ঘুমানোর ৯০ মিনিট এর মধ্যে ঘুম REM ধরণে প্রবেশ করে। এসময় জেগে থাকাকালীন সময়ের মতই হৃদপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। বন্ধ চোখের পাতার ভিতর অক্ষিগোলক নড়াচড়া করে। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয়। আমাদের দেখা প্রায় সকল স্বপ্ন এই পর্যায়ে দেখে থাকি।
তখন মস্তিষ্ক নতুন তথ্য সংরক্ষণ করে, স্নায়ু কোষগুলো পুনর্সজ্জিত হয়। শরীর কোষ এবং ক্ষত স্থানের মেরামত করে, শক্তি সঞ্চয় করে এবং গ্রন্থি গুলো থেকে বিভিন্ন হরমোন নির্গত করে। আমরা ঘুমালে আমাদের পিটুইটারি গ্রন্থি/গ্ল্যান্ড থেকে গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়। যার প্রভাবে আমরা শারীরিক ভাবে বাড়তে পারি।
আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন ঘুম আমাদের শরীর এর বেশ কয়েকটা মৌলিক কাজ গুলোতে সাহায্য করে।
১. শক্তি সঞ্চয়ঃ শক্তি সঞ্চয় করার জন্য আমাদের ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমের সময় আমাদের বিপাককার্য বা মেটাবলিজম কমে যায়। এভাবে ঘুম আমাদের ক্যালোরির চাহিদা কমায়।গবেষণা বলে যে, আমাদের দিনে আট ঘন্টা ঘুমানো উচিত। এতে করে আমরা ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্যালোরির চাহিদা কমিয়ে আনতে পারি।
২. কোষ এর মেরামতঃ দেহের ক্ষয় মেরামত এর জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। দিনের বেলা আমাদের দেহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা অসুখের মাধ্যমে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঘুমের সময় পেশির ছিড়ে যাওয়া তন্তুর মেরামত হয় (যারা জিম এ ব্যায়াম করে তাদের মূলত পেশি বৃদ্ধি পায় এই সময়ে)। প্রোটিন সংশ্লেষণ ঘটে এবং বিভিন্ন হরমোন নির্গত হয়।
৩. মস্তিষ্কের কার্যকলাপঃ ঘুমানোর সময় নিউরন কোষগুলো পুনর্সজ্জিত হয়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্র থেকে বিভিন্ন উপাদান নিষ্কাশিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত হয় এবং অপ্রয়োজনীয় তথ্য ছাটাই হয়। শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে লং টার্ম মেমোরি তে তথ্য স্থানান্তর হয় এই সময়ে। এছাড়া শিক্ষণ, সমস্যা সমাধান,স্মৃতি ,সৃজনশীলতা ,সিদ্ধান্ত গ্রহণ ,মনোযোগ ধরে রাখা ইত্যাদি ঘুমের উপর নির্ভর করে।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণঃ গ্রেলিন হরমোন আমাদের খাওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত করে এবং লেপ্টিন হরমোন পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে। এই হরমোনগুলো নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে ঘুম আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। অপর্যাপ্ত ঘুম আমাদের শরীরে গ্রেলিন হরমোন বাড়িয়ে দেয় এবং লেপ্টিন হরমোন কমিয়ে দেয়। যার ফলে ক্ষুধা বেশি লাগে এবং একপর্যায়ে ওজন বাড়তে শুরু করে। সাথে বাড়ে টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
৫. সঠিক ইনসুলিন ক্রিয়াঃ আপনি হয়তো ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের নির্দয় ভাবে শিরা ফুটো করে ইনসুলিন নিতে দেখে থাকবেন। ইনসুলিন চিনি এবং গ্লুকোজ কে ভেঙে শক্তিতে রুপান্তর করতে সাহায্য করে। কম ঘুম শরীরের ইনসুলিন রোধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।যার ফলে রক্তে গ্লুকোজ বাড়তে থাকে।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাঃ একটি সুস্থ এবং শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঘুমের উপর নির্ভর করে। ঘুমের সময় শরীর সাইটোকিন নামক প্রোটিন উৎপন্ন করে, যা বহিরাগত অণুজীব আর ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। এছাড়া এসময় রোগ প্রতিরোধী কোষ এবং এন্টিবডি উৎপন্ন হয়।
৭. হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যঃ The Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এক প্রতিবেদনে বলেছে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে সাত-আট ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন। নিয়মিত এর চেয়ে কম ঘুমালে হৃদপিণ্ড এর স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে।এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। দেহে কর্টিসল হরমোন রিলিজ হয় যা আমাদের দেহ চাপের পরিস্থিতিতে নির্গত করে।
আজকের আলোচনা আপনাদের কেমন লাগলো তা অবশ্যই জানাবেন। ঘুম নিয়ে আরো মজার তথ্য জানতে চাই আপনাদের কাছ থেকে।
No comments