জাপানের রহস্যময় SOS চিহ্ন!
জাপানের রহস্যময় SOS চিহ্ন! ১৯৮৯ সালে কী ঘটেছিল জাপানের মাউন্ট আসাহিদাকে?
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে কথা। টোকিওর দুই পুরুষ হাইকার, জাপানের হোক্কাইদো দ্বীপের মাউন্ট আসাহিদাকের চূড়া পর্যন্ত হাইকিং করার সিদ্ধান্ত নেন। যখন তারা সেখানে পৌঁছালেন তখন তাঁদের মনে হয়েছিল সেটা হয়তো সেইফ রক, কিন্তু আসলে সেটা ছিল ফলস সেইফ রক মানে ভুল জায়গা ।
সেই রাতে যখন তাঁরা বাড়ি ফিরলেন না তখন তাদের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবরা পুলিশকে খবর দেয় এবং তাঁদের খোঁজাও শুরু হয়। পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করেও তাঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। পুলিশও তাদের অবস্থানের ব্যাপারে কোনো ধারণা দিতে পারছিল না।
তারপর ২৪ জুলাই এর ঘটনা। আসাহিদাকে পর্বতের উপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ছিল, এমন একটা জায়গা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল যা আগের খোজাখুজির সময় করা হয়নি। হেলিকপ্টারের পাইলট একটা কোণায় এসে সরাসরি নিচে পর্বতগাত্রের মাঝামাঝি বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পান। সেই বিশাল খালি জায়গাটার ঠিক মাঝখানে বিশাল তিনটা অক্ষর দেখতে পান, "SOS" যা গাছের কাটা গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টারের পাইলট চিহ্নটার উপরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন যেন ঐ দুজন ব্যক্তিকে পাওয়া যায় । কিন্তু ব্যাপক খোজাখুজি করেও তিনি কাউকে খুজে পেতে ব্যর্থ হন।
অবশ্য তিনি বাকি খোঁজকর্তাদের জানিয়ে দিলেন যে তিনি SOS চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। তারপর আরও হেলিকপ্টার ও গাড়ি নিয়ে হাইকারদের খুঁজতে লোকজন সেখানে চলে আসে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর মাটিতে থাকা একদল খোঁজকারী দেখতে পেলেন শীর্ণকায় দুই ব্যক্তি বাঁশবাগানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। লোক দুটো খোঁজকারীদের দিকেই যাচ্ছিলো। পরে জানা গেল, এরাই সেই হারিয়ে যাওয়া টোকিওবাসী দুই হাইকার। তাঁরা একদম শুকনো, ছেঁড়া কাপড় পরা, পানিশূন্যতায় ভুগছিলো ও ক্ষুধার্তও ছিল। অবাক করা বিষয় এত কিছুর পরও তারা জীবিত ছিল।
একটা হেলিকপ্টার এসে তাদের উদ্ধার করে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসার পর তাঁরা দুজনই সেরে ওঠেন। খবর শুনে খুশি হয়ে সেই পাইলট ও কিছু উদ্ধারকর্মী হাসপাতালে তাদের সাথে দেখা করতে যায়। সেই পাইলট তাঁদের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করলো এই বলে যে তাঁরা বুদ্ধি করে SOS চিহ্ন তৈরি করেছেন, যার কারণেই তারা বেঁচে গেছেন। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নেয় এখান থেকেই। দুই হাইকার তো এটা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বললেন যে কীসের SOS চিহ্ন ? তাঁরা এমন কোনো চিহ্ন তৈরি করেননি।
উদ্ধারকারীরা এই দুই ব্যক্তির সাথে এ বিষয়ে কিছুক্ষণ কথোপকথন করেন জানার জন্য যে তাঁরা আসলেই সত্য বলছেন কিনা। পরে তাঁরা আবার সেই পর্বতে গেলেন এই ভেবে যে এঁরা চিহ্নটা তৈরি না করলে অন্য কেউ নিশ্চয়ই বিপদে পড়ে তৈরি করেছে।
সন্ধান শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধানকারীদের মধ্যে একজন একটা গাছের শিকড়ের নিচে একটা গভীর গর্ত পান। গর্তে একটা ব্যাগ ছিল। ব্যাগে অন্যান্য জিনিসের সাথে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং একটা অডিও রেকর্ডার ছিল। ড্রাইভিং লাইসেন্সটা জাপানি ২৫ বছর বয়সী হাইকার কেঞ্জি ইওয়ামুরার যিনি ৫ বছর আগে পর্বতটার কাছে একটি লজে থাকতেন। তারপর একদিন তিনি লজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে লজের মালিককে বলে যান তিনি মাউন্ট আসাহিদাকের চূড়ায় হাইকিং করতে যাচ্ছেন। এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন।
এরপর যেদিন কেঞ্জির লজ ছেড়ে দেওয়ার কথা সেদিন তিনি তাকরেননি। তাই লজের মালিক ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লেও কোনো সাড়া না আসায় চাবি দিয়ে খুলে দেখলেন ভেতরে কেউ নেই কিন্তু তাঁর জিনিসপত্র সব পড়ে আছে। মালিকের কাছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগে। এতদিনে তো তার ফিরে আসার কথা। এরপরই মালিক পুলিশকে খবর দিয়ে নিঁখোজ বিবৃতি দেয়। পুলিশ কেঞ্জিকে খোঁজা শুরু করলেও তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি । এবার ১৯৮৯ সালের ঘটনায় ফেরা যাক -
ব্যাগ থেকে অডিও রেকর্ডারটা বের করে প্লে বোতামে চাপলে খুব হৃদয় বিদারক আওয়াজ আসে। একজন ভীত-সন্ত্রস্ত যুবক সাহায্যের জন্য চিৎকার করে ডাকছে। পুলিশরা ধারণা করে এটা কেঞ্জি হবে। জাপানি ভাষায় যুবক বলছে ‘আমি পাহাড়ের ঢালে আটকে গেছি। আমায় সাহায্য করো, SOS। নিচের বাঁশবাগান অনেক ঘন, আমি নামতে পারছি না। যেখানে প্রথম হেলিকপ্টার দেখেছিলাম সেখানেই আটকে আছি। সাহায্য করো, SOS।’ পুলিশের ধারণা যেহেতু রেকর্ডিঙে যুবক বা সম্ভবত কেঞ্জি নিজে SOS বলছে তাই হয়তো সেই SOS চিহ্নটি তৈরি করেছে । তাই পুলিশের মতে তাঁরা চিহ্নটার রহস্য ফাঁস করে ফেলেছেন। এবার কেঞ্জি যে মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ খুঁজে বের করতে হবে।
ব্যাগ যেখানে পাওয়া গেছিলো তার আশেপাশে কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর তারা এমন কিছু পায় যেটাতে পুলিশ ধারণা করে যে কেঞ্জির সাথে কী হয়েছিল তা স্পষ্ট। কেঞ্জি হাইকিং করতে মাউন্ট আসাহিদাকেতে যায় এবং ঐ দুজন হাইকারের মতো ভুলবশত ফলস সেইফ রকে চলে যায়। তারপর পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে নিচের ঘন বাঁশবাগান ও খাড়া ঢালের জন্য মাঝপথে আটকে যায়। এখান থেকে উপরে আরোহণ করাও মুশকিল, নিচে নামাও মুশকিল। তখন একটা হেলিকপ্টার উড়ে যায় যা কেঞ্জিকে দেখতে পায়নি। কেঞ্জি সাহায্যের আশায় বার্তা রেকর্ড করেন। কয়েকদিন এখানেই কাটানোর পর তিনি ভাবেন যে এভাবে হেলিকপ্টারের আশায় বসে থাকলে, বাঁচতে হলে নিচে নামতেই হবে। এরপর কেঞ্জি বহু কষ্টে কোনো আঘাত ছাড়াই নিচে নামতে সক্ষম হন। এরপর তিনি বাঁশবাগান থেকে বেরিয়ে সেই ফাঁকা জায়গায় চলে আসেন এবং SOS চিহ্নটা নির্মাণ করেন। কিন্তু সাহায্য পৌঁছায়নি তাই তিনি মারা যান।
পুলিশরা যে জিনিসটা পেয়েছিলেন সেটা হলো ব্যাগ যেখানে পাওয়া গেছিল তার কাছেই পড়ে থাকা একটা মানুষের কঙ্কাল। পুলিশ ধারণা করে এটা কেঞ্জির কঙ্কাল কিন্তু কেঞ্জির মৃত্যুর কারণ তারা জানায়নি। পুলিশ কেস বন্ধ করে দেয় যে সব সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু ১৯৮৯ সালে এই ঘটনা অনেক সাড়া ফেলেছিল তাই অনেকে এই ঘটনা নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁদের মতে পুলিশের তদন্তে কিছু তো ছাড়া পড়েছে। একটা বিষয়ে অসঙ্গতি আছে। পর্যবেক্ষণকারীদের মতো এত বড় একটা SOS চিহ্ন এতগুলো গাছের গুঁড়ি দিয়ে কেঞ্জি একা কীভাবে বানাতে পারেন ! কেঞ্জি হারিয়ে যাওয়ার ধকলে এমনি ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিধ্বস্ত। এমন অবস্থায় ১৯ টা গাছ কুড়াল দিয়ে কাটার শক্তি তিনি কীভাবে পাবেন? এটা প্রকাণ্ড শক্তির কাজ। এমনকি যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক, শক্তিশালী তার পক্ষেও কুড়াল দিয়ে ১৯ টা গাছ কাটা চাট্টিখানি কথা নয়।
কেঞ্জি যে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল তাতে তাঁর পক্ষে হাঁটাও কঠিন। আবার কেঞ্জিকে নিয়ে যিনি ময়নাতদন্ত করেছিলেন তিনি বলেন যে এই অবস্থায় ছিলেন না যে তিনি একটা গাছ ঠিক করে কাটতে পারবেন, ১৯ টা তো দূরের কথা। ওদিকে SOS চিহ্নটার আশেপাশে কোনো কাটার যন্ত্র বা কুড়ালও পাওয়া যায়নি। কিন্তু চিহ্নের গাছগুলো সুন্দর করে কাটা যেন কুড়াল দিয়ে কাটা হয়েছে। পুলিশ যখন এর কোনো যোগ্য জবাব দিতে পারলো না তখন পর্যবেক্ষণকারীরা নিজেদের তত্ত্ব দেওয়া শুরু করেন যে কী হয়েছে। তাঁদের মতে কেঞ্জি একা ছিলেন না। অনেকে মিলে SOS চিহ্নটা বানিয়েছেন। এই ঘটনা আরেকটা জিনিসের ব্যাখ্যা দেয় যে কেঞ্জির পরিবারকে সেই রেকর্ড করা আওয়াজটা প্রথমবার শোনানো হলে তারা বলেছিলেন যুবকের গলা কেঞ্জির মতো নয়। তার মানে এই গলার আওয়াজ কেঞ্জির সহযাত্রীর।
পর্যবেক্ষণকারীরা এটাও বলে বসেন, যে কঙ্কালটা পাওয়া গেছিল সেটা O-গ্রুপের রক্তযুক্ত কোনো মহিলার। গণমাধ্যম ও জনগণ এতে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর পুলিশ হঠাৎ বলে, ‘আমরা হাড়গুলো আবার দেখেছি । ওগুলো কোনো O-গ্রুপের রক্তযুক্ত মহিলার নয় বরং A-গ্রুপের রক্তযুক্ত পুরুষের ।’ এর সাথে কেঞ্জির লিঙ্গ ও রক্তের ধরন মিলে যায় । এরপর পুলিশ কেস বন্ধ করে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে পুলিশ কেসে ঠিকমতো তদন্ত করতে না পারায় কেসটাকে যেমনতেমন করে বন্ধ করতে চাইছে। তাঁদের মতে কঙ্কালটা O-গ্রুপের রক্তযুক্ত কোনো মহিলার যিনি কেঞ্জির সহযাত্রী এবং কেঞ্জি হয়তো এখনও জীবিত। যদিও কোনো তত্ত্বই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে এতটুকু বলা যায়, পর্বতের গায়ে তৈরী সেই SOS চিহ্নটার কারণে দুজনের জীবন বেঁচেছে।
No comments